
বাংলাদেশের রাজনীতিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচন কেবল একটি সাংবিধানিক প্রক্রিয়া নয় বরং এটি যেন এক বিশাল সামাজিক ও অর্থনৈতিক উৎসব। নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসে, রাজনৈতিক অঙ্গনও তত উষ্ণ হতে থাকে। পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায় যে, ক্ষমতার কেন্দ্রে পৌঁছানোর প্রতিযোগিতা অনেকটা চাক ভাঙা মধুর মতো হয়ে ওঠে। চাক ভাঙলে যেমন অসংখ্য মৌমাছি মধুর টানে ছুটে আসে, তেমনি সংসদ নির্বাচন সামনে এলে দলীয় মনোনয়ন, জনপ্রিয়তা, ক্ষমতার ভাগ ও স্বার্থরক্ষায় নানামুখী প্রতিযোগিতা শুরু হয়।
ক্ষমতার মধু ও মনোনয়নপ্রত্যাশীর ভিড়ঃ
বাংলাদেশে সংসদ সদস্যপদ শুধু রাজনৈতিক দায়িত্ব নয়, এটি সামাজিক প্রভাব, অর্থনৈতিক সুযোগ এবং প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণেরও প্রতীক। তাই নির্বাচনের আগে প্রার্থিতা ঘিরে সারা দেশে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়। দলীয় মনোনয়ন ফরম সংগ্রহে যে ভিড় দেখা যায়, সেটি যেন মৌমাছির চাক ভাঙার পর ঝাঁপিয়ে পড়া মৌমাছিদের দৃশ্যের সঙ্গে মিলে যায়। কেউ আদর্শিক অবস্থান থেকে, কেউ দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক ত্যাগের দাবিতে, আবার কেউবা অর্থ ও প্রভাব খাটিয়ে মনোনয়ন পাওয়ার প্রতিযোগিতায় নামে।
পূর্ববর্তী সংসদ নির্বাচনের তথ্য-পরিসংখ্যানঃ
বাংলাদেশের নির্বাচনী ইতিহাসে ভোটার উপস্থিতি কখনো উচ্ছ্বাসের, কখনো অনাগ্রহের প্রতিফলন ঘটিয়েছে।
২০০৮ সালের ৯ম সংসদ নির্বাচন: ভোটার উপস্থিতি ছিল প্রায় ৮৭%, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। এটি ছিল পরিবর্তনের নির্বাচন, যেখানে তরুণ ভোটারদের অংশগ্রহণ ছিল নজিরবিহীন।
২০১৪ সালের ১০ম সংসদ নির্বাচনঃ
বিরোধী দলের বর্জনের কারণে ভোটার উপস্থিতি নেমে যায় প্রায় ৪০%–এ। প্রায় ১৫১ আসনে প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হন।
২০১৮ সালের ১১তম সংসদ নির্বাচনঃ
ভোটার উপস্থিতি বেড়ে দাঁড়ায় ৮২%–এরও বেশি। তবে এই নির্বাচনে কারচুপি ও অনিয়মের অভিযোগ উঠে। যাকে বলা হয় দিনের ভোট রাতের নির্বাচন।
২০২৪ সালের ১২তম সংসদ নির্বাচনঃ
ভোটার উপস্থিতি ছিল মাত্র ৪১.৮%। ঢাকা শহরের কিছু আসনে (যেমন ঢাকা-১৫) ভোটার উপস্থিতি নেমে আসে ১৩%–এ, অথচ গোপালগঞ্জ-৩ আসনে উপস্থিতি ছিল ৮৭%। এই বৈষম্য ভোটারদের আস্থা ও আগ্রহের ভিন্নতাকে স্পষ্ট করে। এ নির্বাচনকে ডামি নির্বাচন বলা হয়।
এই পরিসংখ্যান প্রমাণ করে, কখনো জনগণের অংশগ্রহণ চাক ভাঙা মধুর মতো উচ্ছ্বাসমুখর, আবার কখনো তা অনাগ্রহ ও হতাশায় ভরে ওঠে।
ভোটারদের গুরুত্বঃ
হনির্বাচনের আগে ও পরে-
ভোটাররা গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি। কিন্তু আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে তাদের গুরুত্ব যেন নির্বাচনের আগে সীমাবদ্ধ থাকে। প্রতিশ্রুতির ঝাঁপি নিয়ে প্রার্থীরা দোরে দোরে ঘুরে বেড়ান, উন্নয়ন, কর্মসংস্থান, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, অবকাঠামো উন্নয়ন—সব কিছুতেই আশ্বাস দেন। কিন্তু নির্বাচন শেষে সেই প্রতিশ্রুতির অনেকটাই মিলিয়ে যায়। ফলে ভোটাররা মনে করেন, চাক ভাঙার পর মধুর সামান্য স্বাদ তাদের ভাগ্যে এলেও দীর্ঘমেয়াদে তা আর হাতে থাকে না।
স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর সক্রিয়তাঃ
সংসদ নির্বাচন ঘিরে শুধু রাজনীতিকরাই নন, নানা স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীও সক্রিয় হয়ে ওঠে। ব্যবসায়ী, ঠিকাদার, ভূমি ও শিল্প মালিকরা নির্বাচনে বিনিয়োগ করেন ভবিষ্যতের সুফল আদায়ের আশায়। এভাবে নির্বাচনের প্রতিযোগিতা অনেক সময় মতাদর্শ নয় বরং অর্থ ও ক্ষমতার মধুর চারপাশে আবর্তিত হয়। এতে রাজনৈতিক দলগুলোও অনেক সময় প্রকৃত কর্মী বা ত্যাগীদের বাদ দিয়ে আর্থিকভাবে শক্তিশালী প্রার্থীর প্রতি ঝুঁকে পড়ে।
নির্বাচন ও সহিংসতার আশঙ্কাঃ
প্রতিবার নির্বাচনের আগে যেমন রাজনৈতিক অঙ্গনে চাঙ্গাভাব তৈরি হয়, তেমনি অস্থিরতা ও সহিংসতার আশঙ্কাও বেড়ে যায়। কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ, মনোনয়ন নিয়ে দ্বন্দ্ব, ভোটকেন্দ্র দখল, অনিয়মের অভিযোগ—এসব বিষয় নির্বাচনকে শুধু গণতান্ত্রিক উৎসব নয়, অনেক সময় অরাজকতার রূপও দেয়। ফলে নির্বাচন-পরবর্তী রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রশ্নের মুখে পড়ে।
গণতন্ত্র সুসংহত করার প্রশ্নঃ
বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল গণতান্ত্রিক দেশে নির্বাচনকে শুধুমাত্র ক্ষমতার মধু ভাগাভাগির প্রতিযোগিতা না বানিয়ে জনগণের রায়ের প্রকৃত প্রতিফলন ঘটানোর বিষয়টি এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। নির্বাচন যেন প্রকৃত অর্থে জবাবদিহি, সুশাসন এবং জনগণের আস্থা অর্জনের মাধ্যম হয়, সেটি নিশ্চিত করা জরুরি।
উপসংহারঃ
সংসদ নির্বাচনকে অনেকেই চাক ভাঙা মধুর সঙ্গে তুলনা করেন—কারণ এ সময় রাজনৈতিক অঙ্গন, স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী ও সাধারণ জনগণ সবাই এক অদ্ভুত টানে আকৃষ্ট হন। কিন্তু মধুর স্বাদ যেমন দীর্ঘস্থায়ী হয় না, তেমনি নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি ও জনআকাঙ্ক্ষাও অনেক সময় হারিয়ে যায়। গণতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখতে হলে এই চাকভাঙা মধুর প্রতিযোগিতাকে সীমিত না রেখে জনগণের প্রকৃত কল্যাণে রূপান্তরিত করা এখন সময়ের দাবি।