
বিশেষ প্রতিনিধিঃ সোমবার, ২৭ অক্টোবর ২০২৫
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে সারা দেশে যেমন রাজনৈতিক তৎপরতা বেড়েছে, তেমনি রাজশাহী বিভাগের অন্যতম আলোচিত আসন জয়পুরহাট-২ নিয়েও উত্তাপ ছড়াতে শুরু করেছে। কালাই, ক্ষেতলাল ও আক্কেলপুর উপজেলা নিয়ে গঠিত এই আসনটি একসময় বিএনপির দূর্গ হিসেবে পরিচিত ছিল। ১৯৯১ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত এই আসনে বারবার জয় পেয়েছে দলটি। কিন্তু ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণ না করার পর থেকে পাল্টে যায় রাজনৈতিক চিত্র।
বর্তমানে আসনটি নিয়ে বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে নীরব এক প্রতিদ্বন্দ্বিতা তৈরি হয়েছে। বিএনপি মাঠে ছয়জন মনোনয়নপ্রত্যাশী নিয়ে বিভক্ত, আর জামায়াত একক প্রার্থী নিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে প্রস্তুত—এই বৈপরীত্যই এখন জয়পুরহাট-২ এর রাজনীতির মূল চিত্র।
আগামী জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে জয়পুরহাট-২ আসনে বইছে নির্বাচনী হাওয়া। একদিকে মনোনয়ন প্রত্যাশী ছয় বিএনপি নেতা ব্যস্ত নিজেদের অবস্থান শক্ত করতে, অন্যদিকে সংগঠিত জামায়াত ঘরে ঘরে প্রচারে জোর দিচ্ছে। কিন্তু বিএনপির অভ্যন্তরীণ কোন্দল তাদের পুনরুদ্ধারের স্বপ্নকে কতটা বাস্তবায়ন করতে পারবে—সেই প্রশ্ন এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে।






o
রাজনৈতিক পটভূমিঃ হারানো দূর্গ পুনরুদ্ধারের লড়াই-
জয়পুরহাট-২ আসনটি দীর্ঘদিন ধরে জাতীয় রাজনীতিতে বিএনপির শক্ত ঘাঁটি হিসেবে বিবেচিত হতো। সাবেক এমপি ইঞ্জিনিয়ার গোলাম মোস্তফার উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড ও দলীয় তৃণমূলের সুসংগঠিত উপস্থিতি তখন এই আসনকে “বিএনপি ব্যাস্টিয়ন” হিসেবে পরিচিত করেছিল।
কিন্তু ২০১৪ সালে বিএনপির নির্বাচন বর্জন, পরে ২০১৮ সালের নির্বাচনে সাংগঠনিক দুর্বলতা ও অভ্যন্তরীণ বিভক্তি—সব মিলিয়ে এই আসনটি আওয়ামী লীগের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। এরপর থেকেই বিএনপি “আসন পুনরুদ্ধার” মিশনে নেমেছে।
কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে—দলটি এখনও মনোনয়ন নিয়ে একমত হতে পারেনি। ছয়জন সম্ভাব্য প্রার্থী নিজেদের অবস্থান শক্ত করতে মাঠে নামায় তৃণমূল নেতাকর্মীরা বিভক্ত হয়ে পড়েছেন। এ অবস্থায় ঐক্যবদ্ধ জামায়াতের সংগঠিত প্রচারণা বিএনপির জন্য নতুন উদ্বেগ তৈরি করেছে।
বিএনপির ছয় প্রার্থীঃ প্রত্যেকে শক্তিশালী, কিন্তু একসঙ্গে বিভক্ত-
বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশীদের মধ্যে সবচেয়ে অভিজ্ঞ ও জনপ্রিয় মুখ সাবেক এমপি ইঞ্জিনিয়ার গোলাম মোস্তফা। তিনি বুয়েট থেকে পাস করে প্রকৌশলী হিসেবে সুনাম অর্জন করেন, পরে সংসদ সদস্য হয়ে এলাকায় সড়ক, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করেন। তাঁর কথায়—
“আমি দায়িত্ব পালন করেছি, শুধু প্রতিশ্রুতি দিইনি। মানুষের পাশে ছিলাম এবং থাকব।”
তৃণমূলের সঙ্গে দীর্ঘদিনের সম্পর্ক তাঁকে আবারও মনোনয়নের দৌড়ে এগিয়ে রেখেছে।
আরেকজন শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী এএইচএম ওবায়দুর রহমান চন্দন, রাজশাহী বিভাগের সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক। ১৪ বছর ধরে দলের সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে তিনি সক্রিয়, আর কর্মীবান্ধব মনোভাবের কারণে মাঠপর্যায়ের নেতাকর্মীদের আস্থাভাজন। তাঁর ভাষায়—
“রাজনীতিকে আমি দেখি জনগণের অধিকার আদায়ের হাতিয়ার হিসেবে।”
চন্দনকে অনেকে তারেক রহমানের ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে বিবেচনা করেন, যা তাঁকে কেন্দ্রে প্রভাবশালী অবস্থানে রেখেছে।
সাবেক সচিব আব্দুল বারী এই আসনের রাজনীতিতে নতুন কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। দীর্ঘ প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা ও সুনাম তাঁকে সাধারণ মানুষের কাছে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলেছে। প্রশাসনে সততা ও দক্ষতার জন্য পরিচিত বারী মনে করেন—
“রাজনীতিতে সুশাসন ও নীতিনিষ্ঠ নেতৃত্ব আনতে অভিজ্ঞতা ও স্বচ্ছতা জরুরি।”
তাঁর আগমন বিএনপির রাজনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে, বিশেষ করে বুদ্ধিজীবী ও পেশাজীবী মহলে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রনেতা আব্বাস আলী, যিনি দীর্ঘ ১৭ বছর ধরে আওয়ামী লীগবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয়। তাঁর ত্যাগ ও রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা তাঁকে তরুণ নেতাকর্মীদের কাছে গ্রহণযোগ্য করেছে। তাঁর নিজের ভাষায়—
“আমি প্রতিশ্রুতির রাজনীতি করি না, আমি করি সাহসের রাজনীতি।”
তরুণ প্রজন্মের প্রতিনিধি হিসেবে উঠে এসেছেন প্রবাসী ব্যবসায়ী ইঞ্জিনিয়ার আমিনুর ইসলাম। বিদেশে অবস্থান করেও শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও মানবিক সহায়তায় তাঁর অবদান এলাকায় পরিচিতি এনে দিয়েছে। তিনি ২০২৫ সালে সিআইপি (এনআরবি) হিসেবে স্বীকৃতি পান। প্রযুক্তিনির্ভর উন্নয়ন ভাবনায় বিশ্বাসী এই প্রবাসী বলেন—
“দেশকে এগিয়ে নিতে হলে প্রবাসের অভিজ্ঞতা আর স্থানীয় বাস্তবতার সমন্বয় জরুরি।”
অন্যদিকে লায়ন সিরাজুল ইসলাম বিদ্যুৎ, জাতীয়তাবাদী কৃষক দলের জলবায়ু বিষয়ক সম্পাদক, স্থানীয় পর্যায়ে কৃষক ও পরিবেশ ইস্যুতে তৃণমূলের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন। জলবায়ু সংকট, কৃষকের ন্যায্য মূল্য এবং কৃষিনির্ভর উন্নয়ন নিয়ে তাঁর কাজ ভোটারদের কাছে ইতিবাচক বার্তা দিয়েছে।
এই ছয় প্রার্থীই দলীয়ভাবে শক্তিশালী ও প্রভাবশালী হলেও, তাঁদের পারস্পরিক প্রতিযোগিতা বিএনপির জন্য এখন সবচেয়ে বড় বাধা। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে একাধিক গ্রুপে বিভক্ত নেতাকর্মীরা নিজেদের প্রার্থীর পক্ষে অবস্থান নিচ্ছেন—যা শেষ পর্যন্ত মূল নির্বাচনী লড়াইয়ে বিএনপিকে দুর্বল করে দিতে পারে।
ঐক্যবদ্ধ জামায়াতঃ সংগঠনের শৃঙ্খলা ও মাঠের সক্রিয়তা-
বিএনপি যেখানে বিভক্ত, সেখানে জামায়াত এখন ঐক্যবদ্ধ ও সংগঠিত। জেলা জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি এস. এম. রাশেদুল আলম সবুজ এই আসনে দলের একক প্রার্থী হিসেবে কার্যত নির্বাচনী মাঠে নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
তিনি আক্কেলপুর উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান এবং ছাত্রশিবিরের সাবেক জেলা সভাপতি। রাজনৈতিক জীবনের শুরু থেকেই সংগঠনের ভেতরে পরিশ্রম ও পরিকল্পনায় পরিচিত সবুজ এখন মাঠপর্যায়ে তৃণমূল কর্মীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত। তাঁর রাজনৈতিক মূলমন্ত্র—
আমার প্রার্থিতা দল নয়, আদর্শের প্রতিনিধিত্বঃ
তৃণমূল পর্যায়ে জামায়াতের ঘরোয়া বৈঠক, সামাজিক কার্যক্রম ও যুবসম্পৃক্ত কর্মসূচি এখন বিএনপির তুলনায় বেশি দৃশ্যমান। নারী ভোটারদের সঙ্গেও জামায়াত নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করছে, যা আসনটিতে উল্লেখযোগ্য ভোট ব্যাংক তৈরি করতে পারে।
ভোটার সমীকরণ ও সামাজিক বাস্তবতাঃ
জয়পুরহাট-২ আসনে পুরুষ ভোটারের চেয়ে নারী ভোটার বেশি। স্থানীয় বিশ্লেষকদের মতে, নারী ভোটারদের একটি বড় অংশ এখনো সিদ্ধান্তহীন—তারা ব্যক্তির গ্রহণযোগ্যতাকে বেশি গুরুত্ব দেয় দলীয় প্রতীকের চেয়ে।
গ্রামীণ অর্থনীতি, প্রবাসী আয়, কৃষি ও শিক্ষাব্যবস্থা—এসব ইস্যু এবার নির্বাচনী আলোচনার কেন্দ্রে। অনেকেই বলছেন, তরুণ প্রজন্ম এবার প্রার্থীর সততা ও আধুনিক চিন্তাভাবনাকে মূল্যায়ন করবে।
সামাজিকভাবে এ আসনে ধর্মীয় মূল্যবোধ বেশ গভীরভাবে প্রোথিত। এ কারণে জামায়াতের “নৈতিক রাজনীতি” বার্তা ভোটারদের একাংশের মধ্যে গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে। তবে দীর্ঘদিনের সাংগঠনিক শিকড় থাকায় বিএনপির মাঠভিত্তিক ভোটার এখনো অটুট আছে, যা শেষ পর্যন্ত পাল্লা ভারী করে তুলতে পারে—যদি দলটি ঐক্যবদ্ধ হতে পারে।
অভ্যন্তরীণ ঐক্যই হবে জয় বা পরাজয়ের চাবিকাঠিঃ
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, জয়পুরহাট-২ আসনের ভোটাররা দল নয়, প্রার্থী দেখে ভোট দেন। তাই যোগ্য, গ্রহণযোগ্য ও সংঘাতমুক্ত প্রার্থী মনোনয়ন দিতে পারলে বিএনপি এখনো ঘুরে দাঁড়াতে পারে। কিন্তু যদি মনোনয়ন নিয়ে দ্বন্দ্ব বজায় থাকে এবং একাধিক প্রার্থী বিদ্রোহী হিসেবে দাঁড়ান, তাহলে বিএনপি আবারও আসন হারাতে পারে—যেমনটি ঘটেছিল ২০১৮ সালে।
অন্যদিকে জামায়াত এখন পর্যন্ত ঐক্যবদ্ধ, শৃঙ্খলাবদ্ধ ও তৃণমূলমুখী। তারা সামাজিক সংযোগ, ধর্মীয় মূল্যবোধ ও যুবসম্পৃক্ততায় সফলভাবে অবস্থান শক্ত করছে। ফলে বিএনপি-জামায়াত সম্পর্ক যেমন সহযোগিতার, তেমনি প্রতিদ্বন্দ্বিতারও—এই নির্বাচনে সেটিই নির্ধারণ করবে আসনটির ভাগ্য।
জয়পুরহাট-২ আসনের রাজনীতি এখন এক অনিশ্চিত ভারসাম্যে দাঁড়িয়ে আছে। একদিকে বিএনপির অভ্যন্তরীণ বিভাজন ও মনোনয়ন প্রতিযোগিতা, অন্যদিকে জামায়াতের সংগঠিত প্রস্তুতি—দুটিই এই আসনকে জাতীয় পর্যায়ের আলোচনায় নিয়ে এসেছে। যদি বিএনপি শেষ সময়ে ঐক্যবদ্ধ হয়ে শক্ত প্রার্থী দিতে পারে, তাহলে “হারানো দূর্গ পুনরুদ্ধার” অসম্ভব নয়। কিন্তু যদি দলীয় কোন্দল অব্যাহত থাকে, তাহলে জয়পুরহাট-২ হয়তো আবারও হারাবে তার পুরনো রঙ—আর পাল্লা ভারী হবে ঐক্যবদ্ধ জামায়াতের পক্ষে।
আসন তথ্যচিত্রঃ
জয়পুরহাট-২ (কালাই, ক্ষেতলাল ও আক্কেলপুর)
মোট ভোটারঃ প্রায় ৩.৬৫ লক্ষ (আনুমানিক)
মহিলা ভোটারঃ ৫২%
পুরুষ ভোটারঃ ৪৮%
বিএনপি প্রার্থীঃ ৬ জন
জামায়াত প্রার্থীঃ ১ জন (একক)
সাবেক আসনঃ আওয়ামী লীগ
মূল ইস্যুঃ উন্নয়ন, ধর্মীয় মূল্যবোধ, কর্মসংস্থান, কৃষি
৬ বনাম ১ঃ
বিএনপির ৬ মনোনয়নপ্রত্যাশী বনাম জামায়াতের একক প্রার্থী। ঐক্যের অভাবে বিএনপির দুর্বলতা স্পষ্ট।
নারী ভোটারই নির্ধারণ করবেন ভাগ্যঃ
পুরুষের তুলনায় নারী ভোটার ৪% বেশি
ধর্মীয় ও সামাজিক ইস্যুতে প্রভাব ফেলছেন তাঁরা।
বিএনপিঃ কোন্দল ও প্রতিযোগিতা-
সাবেক এমপি থেকে প্রবাসী উদ্যোক্তা—সবাই মাঠে অভ্যন্তরীণ বিভক্তিই বড় চ্যালেঞ্জ।
জামায়াতঃ সংগঠনের শক্তি-
একক প্রার্থী এস. এম. রাশেদুল আলম সবুজ
শৃঙ্খলাবদ্ধ কর্মীভিত্তি ও সামাজিক সক্রিয়তা।
নতুন মুখের আগমনঃ
সাবেক সচিব আব্দুল বারীর প্রবেশে আলোচনায় নতুন ধারা প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা বনাম মাঠের রাজনীতি।
তরুণ ও প্রবাসীদের প্রভাবঃ
প্রবাসী প্রার্থী ইঞ্জিনিয়ার আমিনুর ইসলামের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ছে তরুণ ভোটারদের মধ্যে প্রযুক্তি-নির্ভর উন্নয়ন বার্তা জনপ্রিয়।
আসনের শক্তি-দুর্বলতা এক নজরেঃ
“কে কোথায় দাঁড়িয়ে”
“ভোটারদের মনোভাবঃ দল নয়, প্রার্থী মুখ্য”
“রাজনৈতিক ভারসাম্যঃ কোন্দল বনাম ঐক্য”
“সম্ভাবনার লড়াইঃ বিএনপি বনাম জামায়াত”
“যদি বিএনপি ঐক্যবদ্ধ হতে পারে, জয়পুরহাট-২ আবার ফিরতে পারে তাদের হাতে। আর যদি না পারে, ঐক্যবদ্ধ জামায়াতই হবে আসনের নতুন সমীকরণ।” রাজনৈতিক বিশ্লেষক